East Bengal Sports

কৃশানু দে – ময়দানের মারাদোনা

২০ সে মার্চ চলে গেলেন আমাদের সবার প্রিয় রন্টুদা বা ভারতীয় ম্যারাডোনা কৃশানু দে!ওনার স্কিল মুগ্ধ করেছিল আপামর ফুটবল প্রেমীদের তাই তাদের কাছে ছিলেন শিল্পী যার পাতে ফুটবল মাঠে আঁকা হয় শিল্প যা দেখতে ছুটে এসে সবাই|

কৃশানু দে
কৃশানু দে


14ই ফেব্রুয়ারী1962 তে কলকাতার গড়িয়া র কাছে নাকতলাতে জন্ম নেন এই শিল্পী, কৃশানু দে|
মা বাবা দুজনেই চাকরি করতেন, দুই ভাই র মধ্যে কৃশানু ছোট.গড়িয়া র এমন একটি মাঠ এর কাছে জন্ম যেখানে খেলে যাননি এমন কোনো খেলোয়াড় ছিলোনা.গোলকীপার হবার স্বপ্নে আঘাত আনলেন বাবা যিনি বোঝালেন এই স্বাস্থ নিয়ে গোলকীপার হওয়া যায়না.ছোট থেকেই পড়াশোনা তে ভালো সাথে ফুটবল ও.প্রভাত সংঘ এর হয়ে প্রায় সব প্রতিযোগিতা তেই দেখা যেত জাদু.প্রধান গুন্ ছিল বাঁপা তে অসাধারণ ডজ সাথে অপূর্ব ফুটবল সেন্স কিন্তু ডানপা দুর্বল.ভেটারেন্স স্পোর্টস ক্লাব এ এসেছিলেন খেলা শিখতে মাত্র 11বছর বয়সে.কোচ ছিলেন সুশীল ভট্টাচার্য.ছোট্ট চেহারার কৃশানু তখনি পা র জাদুতে সবাই কে মুগ্ধ করা শুরু করেছিল.মাত্র 3বছর ওখানে থাকার পর 1977 এ ভারত এ শুরু হয় সাবজুনিয়র জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা সেখানে কৃশানু দে সুযোগ পান 800জন এর মধ্যে থেকে 20জন এর বাংলা দল এ.সেখানেও কোচ হন সুশীলবাবু.মজা হলো ছোট্ট চেহারার জন্য নির্বাচন আটকে গেলেও ifa সেক্রেটারি অশোক ঘোষ এর জন্য দল এ সুযোগ পান রন্টুদা.কিন্তু এর্নাকুলাম এ হওয়া এই টুর্নামেন্ট এ একটি খেলা তে নামেন পরিবর্ত হিসেবে হায়দ্রাবাদ এর বিরুদ্ধে.বাংলা যুগ্মবিজয়ী হয়.পরের বছর বিখ্যাত গোলকীপার মনিস সরকার কৃশানু দে কে নিয়ে যান পুলিশ ক্লাব এ প্রথম ডিভিশন খেলার জন্য.যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পীর.মনিসবাবু প্রথমেই এনারজি বারবার দিকে নজর দিলেন.রেসকোর্স র বালির মাঠে দৌড় করলেন সাথে জিমন্যাস্টিক ট্রেনিং ও ছিল র সাথে অন্য ব্যায়াম.মজা হলো সেই বছরই মোহনবাগানর সাথে খেলাতে বাবলুদাকে মাটি ধরিয়েছিলেন যা প্রথম প্রাপ্তি ছিল.হাবিব কে অনুসরণ করে লেফট স্ট্রাইকার হলেন.পরের বছরই অচ্যুত ব্যানার্জী র হাত ধরে চলে যান পোর্ট দলএ.

কৃশানু দে
কৃশানু দে


অচ্যুত ব্যানার্জী বাঁ ময়দানএ সকলের প্রিয়”স্যার”র প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন কারণ একটা মিল.দুজনেরই বাঁ পা বাঁকা!উনি শেখালেন দুপা দুরকম হলে তার ব্যবহার কিভাবে করতে হয়.ওনার হাত এ পরে প্রথম ডান পা কে ব্যবহার করতে শিখলেন.প্রাকটিস এ বাঁ পা তে বল ধরতেন না শুধু ডান পা দিয়ে স্কিল করতেন ফল ডান পা সমান সচল হয়ে উঠলো র উনি হলেন”সব্যসাচী”.
সৌজন্য অভিষেক

কৃশানু দে
কৃশানু দে

পোর্ট র হয়ে করা অধিকাংশ গোল ডান পা দিয়ে.এই দুটো বছর ছিল কৃশানু হয়ে ওঠার কারণ.অচ্যুত স্যার শেখালেন,1.বল পায়ে প্রাকটিস করিয়ে স্কিল কে পরিণত করলেন.2.নতুন নতুন স্কিল শেখালেন.3.মার খাওয়ার থেকে বাঁচার উপায় শেখালেন. 4.রিডিং দা গেম শেখালেন.মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করলেন.থিওরিটিক্যাল আলোচনা ছিল প্রত্যেকদিন এর অঙ্গ র মাথায় ঢোকালেন গোল করার থেকে খেলা তৈরী করে গোল করানোর মজা আলাদা.ওনার কোচিং এ পোর্ট আন্তঃ রেল চ্যাম্পিয়ন হলো,নজর করলেন কৃশানু কিন্তু স্যার র কথা শুনে র একবছর ওনার কাছে পরিণত হয়ে 1982 তে ময়দান এ বড়োদল মোহনবাগানএ পা রাখলেন রণ্টু দা.

কৃশানু দে
কৃশানু দে

ছিলেন দুবছর র বদনাম কুড়োলেন ওনার স্পিড নাকি কম.মজা হলো সেটা হলেও ওনাকে দৌড় না করিয়ে শুধু জিম করানো হতো যাতে স্পিড বাড়ার কথাও নয়.সংকর ব্যানার্জী কিন্তু আলাদা করে দৌড় করিয়ে এই দুর্বলতা মেটাবার চেষ্টা করেছিলেন.যাইহোক ওদের হয়ে স্ট্রাফোর্ড কাপ এ ডেম্পো র বিরুদ্ধে প্রথম গোল করেছিলেন.
ওই বয়সেই সাবজুনিয়র র জুনিয়র ন্যাশনাল দুবার খেলা হয়ে গিয়েছিলো.একবার অধিনায়ক ও ছিলেন.ওঁর নিজের আক্ষেপ ওঁর স্পিড নিয়ে যা সারাজীবন ছিল.অনেক প্রাক্তন এগিয়েও এসেছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুভাষ ভৌমিক,উনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রতিদিন বিকেলে কৃশানু দে কে বিশেষ প্রাকটিস করাবার যাতে ওঁর স্পিড স্টামিনা বাড়ে কারণ উনি ভাবতেন দেশের সেরা হবার ক্ষমতা আছে কৃশানুর.সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত কারণ ওঁর থেকে পরামর্শ পেতেন সবচেয়ে বেশি.মাত্র 19 বছর বয়সেই pk স্যার ডেকেনিয়েছিলেন এশিয়াডএর ক্যাম্পএ.মজা হলো ওনার নাম প্রথম সব কাগজে এসে তখনি.

প্রথমে মোহনবাগান এ অনিয়মিত থাকলেও পরে নিজের যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নেন.সুরজিৎ সেনগুপ্ত দের স্বর্ণযুগোত্তর এর সবচেয়ে আলোচিত নাম ছিল কৃশানু দে যার নাম এ মাঠ ভর্তি হতো.যার পা দিয়ে মাঠে আঁকা হতো শিল্প.উনি সেই যিনি আজকাল এ শিরোনাম কুড়োলেন,” কৃশানু দে সবাই কে চাপিয়ে গেলেন”.

ছিলেন এক কোচ যিনি 1984 তে বলেছিলেন,”ওকে নিয়ে ভয় এর কিছু নেই.ওটা স্ট্রাইকার এর খেলা নয়.ওতে গোল হয়না.” তিনি আবার কৃশানু হাসপাতাল এ থাকার সময় লিখলেন ,”আমার ম্যারাডোনা.”
1984র এশিয়া কাপ যুবভারতী তে মালয়েসিয়া র বিরুদ্ধে বাবু মানি কে দিয়ে গোল করানো.সুভাষ এর আদর,”লক্ষ টাকার পাস”.
এটা ছিল কৃশানু হয়ে ওঠার শুরু এবার আসি পরবর্তী পর্ব মানে আমাদের পর্ব…
1982 সালের শুরুতে রঞ্জন ব্যানার্জী ইস্টবেঙ্গল এর এক কর্তাকে বলেছিলেন কৃশানু র ব্যাপারে কিন্তু আমাদের এক “বুদ্ধিমান” সিনিয়র খেলোয়াড় এর আপত্তি তে নেয়া যায়নি যদিও এই ভুল বুঝতে সময় লাগেনি কিন্তু যা হবার টা হয়ে গেছিলো.দীপক দাস মানে পল্টু দা পাগলের মতো পরে থেকে রন্টু কে ছিনিয়ে আনলেন আমাদের 1985 তে.শুরু র এক গল্পের..যা পরিণত কৃশানুর.পরের 7টা বছর ছিল আমাদের স্বপ্নের. আলভিটোর আগে এক বাঁ পা এর শিল্পী যিনি মাঠে যা ইচ্ছে করতে পারে, কলকাতা ময়দান ছিল মজিদময় তাকেও ভুলিয়ে দিয়েছিলো কৃশানু র খেলা.এক অতি পুরানো সমর্থক এর ভাষায়, “আমাগো স্বপ্ন রন্টু ময়দান এ এমন জায়গা লইবে কেউ ভুলতে পারুম না!”
1985 থেকে 1991 এই 7বছর কলকাতা র ময়দান পেলো এমন একজন কে যিনি সব পারেন,আমাদের দিলেন 1985 তে ফেড কাপ,1985,1987,1988,1989র 1991 তে কলকাতা লীগ,1986,1990 র 1991 তে শিল্ড,1989,1990,1991 তে ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড,1990তে রোভার্স কাপ,1987,1988,1990তে এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ,নাগাজী কাপ 1986 এছাড়াও স্টাফোর্ড 1986 তে.এর মধ্যে 1990 তে ট্রিmukut ও ছিল.1989 তে ছিলেন আমাদের অধিনায়ক.

1985 ময়দান পেলো তাদের প্রথম জুটি বিকাশ কৃশানু!যা অনেকদিন অবিচ্ছেদ্য ছিল.এই দুজন ছিলেন তখন কার ময়দান এ সবচেয়ে দামি ফুটবলার.1992 থেকে 1993তে মোহনবাগান এ ফিরলেও 1994 তে আবার আমাদের চলে আসেন শেষ করেন ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া র হয়ে 1995 থেকে 1997অবধি খেলে.শেষ হয় এক সোনালী অধ্যায়..

কৃশানু দে
কৃশানু দে


খেলা ছাড়ার পরে ফুড কর্পোরেশন র কালীঘাট কে কোচিং ও করিয়েছিলেন.22সে জুন 1984 তে চীন র বিরুদ্ধে প্রথম দেশের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন.1984 থেকে 1993 অবধি দেশের হয়ে খেলে 10টি গোল করেছিলেন.1986 তে মারদেকা তে মালয়েশিয়া তে থাইল্যান্ড এর বিরুদ্ধে ওনার করা হ্যাট্রিক ছিল দ্বিতীয় বাঙালী র করা আগে ছিলেন সুভাষ ভৌমিক.দেশের হয়ে 1986 তে এশিয়ান গেমস, মারদেকা কাপ,pre-অলিম্পিক,এশিয়ান গেমস ছাড়াও সাফ গেমস ও খেলেন.1992 এশিয়ান গেমস কোয়ালিফায়ার এ দেশ র অধিনায়ক ও ছিলেন.

এবার আসি ওনার ব্যক্তিগত জীবন এ চাকরি করতেন ফুড কর্পোরেশন এ.19ফেব 88তে বিয়ে করেন ছোটবেলার বান্ধবী শর্মিলা দে কে যিনি স্পোর্টস জার্নালিস্ট একটি কাগজ এর.25সে ডিসেম্বর 1990 তে ওনাদের জীবন এ আসে সোহম.
এবার আসি ওকে নিয়ে দলবদল এর গল্পের.1990 সাল বলরাম এর পানোরামা এর অফিস যা টুটু দের ডেরাও ছিল.পরিকল্পনা হলো কৃশানু কে নেবার.কৃশানু মানস বাবু র হাত ধরে গেলেন টুটু র হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট এর বাড়িতে ধর্মতলা র cesc অফিস থেকে.ইস্টবেঙ্গল থেকে পল্টু জমানা শেষ দল চালান সুপ্রকাশ গড়গড়ি,সন্তোষ দত্ত রা.সেবার ফেড কাপ বসলো মাদ্রাজ এ.পনিয়ার পিসি র বাড়ি থেকে কৃশানু কে তুলে এগমোর স্টেশন এর কাছে চান্দ্রা ইন্টারন্যাশনাল এ. পাশের এম্বাসেডর হোটেল র 16নম্বর ঘরে শুরু হলো দরাদরি রাত 12.30 এ.চেক তৈরী কৃশানু বাড়িতে ফোন করে জানালেন উনি মোহনবাগান এ যাচ্ছেন.বিরু কৃশানু র কাগজি তৈরী করতে বসলেন হটাৎ রাঁধুনি সুরেশ কে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এলেন গড়গড়ি বাবু যাকে খবর দিয়েছিলেন অতনু ভট্টাচার্য.এসেই বলে উঠলেন “this is very bad anjanbabu. কৃশানু বিকাশ কে আমরা অ্যাডভান্স করেছি.আপনি এভাবে ওদের নিতে পারেননা.গড়গড়ি খেললেন একটা খেলা যাতে অঞ্জন হলেন শেষ.কৃশানু দের সাথে কথা বলতে চাইলেন র অঞ্জন বোকা র মতো রাজি হয়েও গেলেন.বাস.. র কি…ওদের বললেন,”তোরা এভাবে চলে গেলে সবাই আমায় বটি দিয়ে কেটে ফেলবে, আমার পরিবার কে হেনস্থা করবে,বাড়ি ভাঙচুর করবে তোদের পা ধরছি থেকে যা.বাস কৃশানু গলে কেঁদে ফেলে চেক ফেরত দিলেন র গড়গড়ি দুজন কেই bogol daba করে চান্দ্রা ইন্টারন্যাশনাল এ গেলেন.
1991তেও মজা পার্থ সেনগুপ্ত র থেকে অগ্রিম নিয়েও টুটু র বাড়িতে যান কৃশানু বাস নিতু দাও 500 জন কে নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে.সঙ্গে গেছিলেন কৃশানু র স্ত্রী পনিয়া.কিন্তু ওরা ততক্ষনে পাচার হয়ে গেছিলো হিন্দ সিনেমা র কাছে গোকুল বড়াল স্ট্রিট এ কেষ্ট সাহা র বাড়িতে…

পনিয়ার অভিযোগ ছিল টুটু বাবু নাকি কিডন্যাপ করেন তার জবাবে টুটু বাবু খুকি বলে ডেকে ভুল করেন.ওনাকে শিক্ষা দিতে পার্কস্ট্রিট থানা তে যান সবাই.মজা হলো সৌমেন মিত্র ছিলেন পল্টু দার বন্ধু তিনি ডিসি সাউথ কে যা বলার বলে দিয়েছেন.ফল…আধঘন্টার মধ্যে বলরাম কৃশানু কে নিয়ে হাজির.র মজা বৌ এর ধমকে সিদ্ধান্ত বদলে আবার ইস্ট বেঙ্গল এ ফেরা.সেবার কৃশানু মোহনবাগানকে শর্ত দিলেন বাবলু দা কে সরাতে হবে তবেই উনি যাবেন যদিও যাননি.পরেরবার 16থ এপ্রিল 1992তে airlines কাপ ফাইনাল জিতে পার্কস্ট্রিট এ খেয়ে নিতু র গারি নাকতলা তে কৃশানু দের ছেড়ে এসে কিন্তু 2টো র সময় কৃশানু র ফোন পেয়ে বিরু বাবু এসে নিয়ে জান টাকা র পরিমান ছিল সাড়ে পাঁচ লক্ষ.পরে পারাদ্বীপ পালিয়ে যান সলিল দত্ত র সাথে ইস্ট বেঙ্গল জানতে পারে দুপুরে.
1985 তে ইস্টবেঙ্গল এ আসা জীবন চক্রবর্তী র হাত ধরে.উনি সকাল এ গিয়ে কৃশানু র বাড়ি পরিষ্কার করতে থাকেন যা দেখে লজ্জায় কৃশানু র মা আটকালে বলে ফেলেন চাকরি র ব্যাপারে যা হয়নি কিন্তু ট্যাক্সি র পার্মিট বেরকরে দেন.1994 তে সব শুরু হলো টোকেন প্রথা সেটা অনুযায়ী অফিস এর অনুমতি নিয়ে ক্লাব এ খেলা যাবে.মোহনবাগান কৃশানু কে নিলেও বিকাশ কে নিতেন না সেখানেই নিতু বলেন কৃশানু এলে তবে বিকাশ কেও নেয়া হবে.বাস আবার জুটি!


ওনার সন্মান এ তৈরী করা মূর্তি আজ দেখা যায় পাটুলি তে.ওনার সন্মান এ আন্ডার 19 লীগ ওনাকে উৎসর্গ করে ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন.
সমাপ্ত……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *